শিশু রহমানকে আর ঠেলতে হবে না মায়ের হুইল চেয়ার
আট বছরের আব্দুর রহমান ছিল পঙ্গু মা-বাবার একমাত্র ভরসাস্থল। মা আম্বিয়া খাতুনকে হুইল চেয়ারে করে বেড়াত সে। তবে আর হুইল চেয়ার ঠেলতে হবে না তাকে। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) সকালে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ফার্মপাড়ার ভাড়া বাড়িতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান মা। মাকে হারিয়ে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে অবুঝ দুই শিশুর। আড়াই বছরের আব্দুল্লাহকে কোলে নিয়ে রহমানের গগণবিদারী কান্নায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত জনতা।
স্থানীয়রা জানায়, সন্তান প্রসবের সময় খিঁচুনি হয়ে আম্বিয়ার শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি চোখ। প্রায় দেড় বছর আগে স্বামীকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় চলে আসেন আম্বিয়া। এখানে রেল বস্তিতে ১২০০ টাকা ভাড়ায় একটি ঘরে বসবাস করতেন। স্বামী শহরের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করতেন। কিন্তু ১১ মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনিও। তাই বাধ্য হয়ে আম্বিয়া ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতেন। আর হুইল চেয়ার ঠেলত শিশু আবদুর রহমান। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার।
স্বামী আকতার হোসেন বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম আম্বিয়ার জীবন কেড়ে নিল ঘাতক জন্ডিস। এখন আমি দুই সন্তানকে নিয়ে কী করব? এক সপ্তাহ ধরে জন্ডিসের চিকিৎসা করানো হচ্ছিল। সোমবার সকালে মারা যায় আম্বিয়া। সন্ধ্যায় জানাজা শেষে চুয়াডাঙ্গা জান্নাতুল মাওলা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আকতার হোসেন আরও বলেন, আমার কাজ করার ক্ষমতা নেই। এখন দুটি সন্তানকে নিয়ে কী করে সংসার চালাব বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এর আগে গত ৬ মেে ‘পঙ্গু মা-বাবার একমাত্র ভরসা রহমান’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে প্রতিবেদন নজরে এলে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার, তার স্ত্রী সৈয়দা তাহমিনা, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান, ডা. মিজানুর রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিপুল শরীফসহ স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিবন্ধী আম্বিয়ার পাশে দাঁড়ান।
উল্লেখ্য, সাতক্ষীরা জেলার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের বলাডাঙ্গা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে আম্বিয়া খাতুনের ১৩ বছর আগে বিয়ে হয় যশোর মণিরামপুরের বাদাম বিক্রেতা আক্তার হোসেনের সঙ্গে। কিন্তু এখানে এসেও পিছু ছাড়েনি ভয়াবহ দরিদ্রতা। আম্বিয়ার স্বপ্ন ছিল স্বামীকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার করবেন। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে গড়ে তুলবেন সুখের সংসার।
সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সাতক্ষীরা থেকে আম্বিয়া খাতুন স্বামী আক্তারের হাত ধরে চলে আসেন যশোর শহরে। থাকতেন একটি জীর্ণ বস্তিতে। স্বামীর বাদাম বিক্রির টাকা দিয়ে কোনোমতে চলত তাদের সংসার। বছর ঘুরতে না ঘুরতে আম্বিয়ার কোলজুড়ে আসে আবদুর রহমান। স্বামীর স্বল্প আয় থেকে কিছু টাকা জমাতে থাকেন আম্বিয়া খাতুন।
২০১৮ সালে খুলনার শিরোমণির গিলাতলা মোহাম্মদীয়া হাফেজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করান ছেলে আবদুর রহমানকে। ২০১৯ সালের মার্চে সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়লে আবদুর রহমানকে মাদরাসা থেকে বাড়ি চলে আসতে বলে কর্তৃপক্ষ। আবদুর রহমান হাফেজিয়া পড়ার পাশাপাশি ওই মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করত।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে প্রসববেদনা উঠলে স্ত্রীর মরণাপন্ন অবস্থা দেখা দেয়। পরে যে সম্বল ছিল, তা নিয়ে স্বামী আক্তার আম্বিয়া খাতুনকে ভর্তি করান হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
চিকিৎসরা জানান, খিঁচুনি হয়ে আম্বিয়ার শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি চোখ। অনেক কষ্ট করে আবদুল্লাহ পৃথিবীর মুখ দেখলেও আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান আম্বিয়া খাতুন। এ যেন সন্তান প্রসবের বেদনা কমতে না কমতে আরেকটি দুঃসংবাদ। আম্বিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
আম্বিয়ার দুঃখের এখানেই শেষ নয়। যার কাঁধে ভর করে সব দুঃখ নিয়ে জীবন পাড়ি দেবেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সেই স্বামীকে আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জ জেহালা এলাকায় একটি ট্রাক পেছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। পথচারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করালেও টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা না হওয়ায় সেও পঙ্গুত্ববরণ করে এখন বিছানায়। তাই বাধ্য হয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে আম্বিয়া খাতুন অন্যের দেওয়া হুইলচেয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ছেলে আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহকে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে যা উপার্জন করতেন তা দিয়েই চলত সংসার।
মন্তব্য করুনঃ
মন্তব্য সমূহ (কোন মন্তব্য পাওয়া যায় নি।)