রবিবার, ১৮ মে ২০২৫

নতুন স্বপ্নে অর্থনৈতিক চাকা সচল হওয়ার প্রত্যাশা

বাংলাদেশে মাইক্রোক্রেডিট এখন আর শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার নয়—এটি এক পরিপক্ব আর্থিক খাত। কিন্তু এই খাতের বর্তমান কাঠামো এনজিও নির্ভর হওয়ায় কার্যকারিতা সীমিত থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শনিবার, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নতুন ভবনের উদ্বোধনে তিনি বলেন, সময় এসেছে একে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং কাঠামোয় রূপান্তরের।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ““মাইক্রোক্রেডিট এখনো এনজিও”। যদি প্রকৃত ব্যাংকিং কাঠামোতে একে রূপান্তর না করা হয়, তাহলে এর কার্যকারিতা সীমিত থেকে যাবে। ব্যাংকিং মেজাজে আনতে হলে এটি অবশ্যই একটি আলাদা আইনি কাঠামোর আওতায় আসতে হবে।”

গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা যখন গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করি, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল এটিকে ব্যাংক বলা যাবে কি না। আমরা বলেছিলাম, ‘আমাদেরটাই আসল ব্যাংক, কারণ এটি ট্রাস্ট বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।’ জমানতের প্রয়োজন না থাকলেও আমাদের ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আজ আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অসংখ্য অনিয়ম ও ধ্বংসাত্মক চিত্র দেখতে পাচ্ছি। অন্যদিকে, মাইক্রোক্রেডিট খাত দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে—এটাই প্রমাণ করে এর অন্তর্নিহিত শক্তি। কেউ টাকা নিয়ে পালায়নি, প্রতারণা হয়নি—এটাই প্রকৃত ব্যাংকিংয়ের প্রতিচ্ছবি।”

প্রফেসর ইউনূস বলেন, “মাইক্রোক্রেডিটই ভবিষ্যতের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে আর্থিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, কেবল পুঁজির ভিত্তিতে নয়।”

মাইক্রোক্রেডিট খাতের ক্রমবর্ধমান প্রসার ও জটিলতা বিবেচনায় একটি বিশেষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের পর বিভিন্ন এনজিও একই ধরনের কার্যক্রম শুরু করে, যার ফলে নানারকম উদ্ভাবনী পন্থা ও অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। তখন আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করি, কিন্তু তারা একে নিজেদের দায়িত্বের মধ্যে গণ্য করেনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের পর, অবশেষে প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে একটি রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।”

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যেমন ইউরোপীয় ও আমেরিকান ফুটবল ভিন্ন ধরনের খেলা, তেমনি প্রচলিত ব্যাংকিং ও মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থাও আলাদা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন দিয়ে যদি মাইক্রোক্রেডিট পরিচালনা করা হতো, তাহলে এই খাত নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।”

প্রধান উপদেষ্টা এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “তাঁরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছেন, প্রয়োজনীয় নীতিমালা করেছেন এবং আলাদা কাঠামো তৈরির মাধ্যমে এই খাতকে রক্ষা করেছেন।”

প্রেস উইংকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি আরও জানান, “অন্যান্য দেশেও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেশন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ একটি কার্যকর মডেল দাঁড় করিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।”

অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “রেগুলেটরকে অবশ্যই ইউজার-ফ্রেন্ডলি হতে হবে। যেন কোনো কিছু জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া না হয়। সার্ভিস চার্জ, সেভিংস রিটার্ন যেন সহজবোধ্য হয় এবং উপকারভোগীদের জন্য যেন কার্যক্রম সহজ করা হয়, সে দিকেও নজর দিতে হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বর্তমানে দেশের মাইক্রোক্রেডিট সেক্টরে ব্যাংকিং খাতের প্রায় ১০ শতাংশ সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে। সদস্যদের সঞ্চয় ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং পুঞ্জীভূত উদ্বৃত্ত ৬১ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছেছে। এটি বড় অর্জন। এ খাত এখন প্রায় স্বনির্ভর। দাতা সহায়তার পরিমাণ খুবই সামান্য—মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকার মতো।”

তিনি আরও জানান, “মাইক্রোক্রেডিট খাতে ২৬ হাজার শাখা এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ২০ হাজারের বেশি শাখা রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর হতে হবে। এ লক্ষ্যে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে কাজ করবে।”

তিনি জানান, মাইক্রোক্রেডিটের জন্য একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে, যা শিগগিরই সরকারের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. এম আনিসুজ্জামান চৌধুরীসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।

মন্তব্য করুনঃ

মন্তব্য সমূহ (কোন মন্তব্য পাওয়া যায় নি।)

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ