মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪

বিপদ —আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি পরীক্ষা

 

পার্থিব জীবনে মানুষের ওপর বিভিন্ন সময় নানারকম বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত আপতিত হয়। বিপদাপদে কখনো এ কথা বলা উচিৎ নয়— 'আল্লাহ আমার সঙ্গেই কেন এমন করছেন?' কারণ আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা নেন বেশি। তিনি যাকে পছন্দ করেন তার মর্যাদা আরো বাড়ানোর জন্য তিনি পরীক্ষা নেন। যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা এই পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। নিজেদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু কুরবানির মাধ্যমে তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

আমাদের কেউ পরীক্ষায় পড়ে চাকরি হারিয়ে। কেউ ব্যবসায় ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়ে। জীবনভর অভাবে বা কষ্টে থেকে কেউ কেউ পরীক্ষা দেয়। কারো বেলায় পরীক্ষা হয়তো বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের জটিল অসুখের চিকিৎসায় দিনরাত সংগ্রাম করা। অনেকের নিজেরই নানা ধরণের জটিল অসুখ। কারো বেলায় আবার জমি-জমা, সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে শত্রুতা, শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার, দুশ্চরিত্র স্বামী, পরপুরুষে আসক্ত স্ত্রী, মাদকাসক্ত ছেলে, পরিবারের মুখে কালিমা লেপে দেওয়া মেয়ে— মোটকথা, কোনো না কোনো সমস্যায় আমরা পড়বই। এই সমস্যাগুলো মূলত আমাদের জন্য পরীক্ষা।

পৃথিবীতে আমরা এসেছি পরীক্ষা দিতে; এটা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড়ো বাস্তবতা। আল্লাহর ঘোষণাও এটাই। তিনি বলেন— 'যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন— কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?' (সূরা মুলক ৬৭ : ২)

বিনোদনের নামে নাটক-সিনেমা, গান-বাদ্য, সুখটান ও রঙিন পানিসহ হাজারো পাপ প্রতিনিয়ত ফাঁদ পাতে এই বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দিতে। আর আমরাও বুঝে-না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিই‌। এসব নষ্ট বিনোদনে বুঁদ হয়ে জীবনের কষ্ট ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা করি।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে— আমরা যতই এগুলোতে গা ভাসাই, ততই এগুলোর প্রতি আসক্ত হই। যতক্ষণ এসবে ডুবে থাকি, ততক্ষণ জীবনটা আনন্দময় মনে হয়। তারপর এসব শেষ হয়ে গেলেই অবসাদ, বিরক্তি, একঘেয়েমি আমাদেরকে ঘিরে ধরে। ধীরে ধীরে একসময় আমরা জীবনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠি। কেন আমার নেই, কিন্তু ওর আছে? কেন আমার বেলায়ই এমন হয়? এসব অবান্তর প্রশ্ন করে করে আমরা আমাদের অন্তরজ্বালায় ইন্ধন যোগাই। অথচ এতসব অশান্তির মূল কারণ হলো— আমরা যে পার্থিব জীবনে পরীক্ষা দিতে এসেছি; এই কঠিন বাস্তবতাকে ভুলে যাওয়া।

বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত বান্দার ঈমানি পরীক্ষা ও ধৈর্য যাচাই করার অন্যতম মাধ্যম। যদিও ধৈর্যশীল বান্দা হিসেবে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা সহজ নয়। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, বিপদ-মুসিবত শুধু আজাবই নয় বরং তা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পরীক্ষাও বটে। আল্লাহ তায়ালা বলেন— 'আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জানমালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।' (সূরা বাকারা ২ : ১৫৫)

পবিত্র কুরআনের আলোকে বুঝা যায়— এ সকল কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র উপায় হলো সবর তথা ধৈর্য অবলম্বন করা আর আল্লাহ তায়ালার বিধান মোতাবেক তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থাকা। তবেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।

তাছাড়া হাদিসের আলোকে আমরা জানতে পারি— বিপদাপদ বা দুঃখকষ্ট আল্লাহ তায়ালা তাঁর নৈকট্যবান বান্দাদেরই বেশি দিয়ে থাকেন। প্রখ্যাত সাহাবি সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি বললাম— হে আল্লাহর রাসূল! কোন মানুষের সর্বাপেক্ষা কঠিন পরীক্ষা হয়? তিনি বলেনঃ নবীগণের। অতঃপর মর্যাদার দিক থেকে তাদের পরবর্তীদের, অতঃপর তাদের পরবর্তীগণের। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের মাত্রা অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। যদি সে তার দীনদারিতে অবিচল থাকে তবে তার পরীক্ষাও হয় ততটা কঠিন। আর যদি সে দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তবে তার পরীক্ষাও তদনুপাতে হয়। অতঃপর বান্দা অহরহ বিপদ-আপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। শেষে সে পৃথিবীর বুকে গুনাহমুক্ত হয়ে পাকসাফ অবস্থায় বিচরণ করে। (ইবনু মাজাহ ৪০২৩)

তাই তো পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রাসূলের পরীক্ষা নিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।

তিনি আদম আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন জান্নাত থেকে জনমানবহীন দুনিয়ায় প্রেরণের মাধ্যমে!

নূহ আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন মহাপ্লাবনের মাধ্যমে! ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মাধ্যমে! মূসা আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন অত্যাচারী শাসকের নিপীড়নের মাধ্যমে! হারুন আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন বনি ইসরাইল কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে! ইয়াকুব আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন অন্ধত্বের মাধ্যমে! ইউসুফ আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন আপনজন থেকে বিচ্ছেদের মাধ্যমে! আইয়ুব আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন দুরারোগ্য ব্যাধির মাধ্যমে! ইউনুস আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে! দাউদ আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন যুদ্ধ-বিগ্ৰহের মাধ্যমে! সুলাইমান আলাইহিস সালামের পরীক্ষা নিয়েছেন বিশাল রাজত্ব প্রদানের মাধ্যমে!

আর সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা নিয়েছেন তাঁর বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর! জন্মের আগে বাবা আবদুল্লাহর মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর বিপদ বা পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর একে একে তিনি হারিয়েছেন মমতাময়ী মা আমিনা, বটবৃক্ষসদৃশ ছায়াদানকারী দাদা আঃ মুত্তালিব, পিতৃবৎসল চাচা আবু তালিব, সন্তান গর্ভধারণকারী একমাত্র স্ত্রী খাদিজা রা. কে। চোখের জলে কবর দিয়েছেন তিন পুত্রসন্তান কাসেম, তাহের ও ইবরাহিমকে। সারাজীবন বিশেষত নবুওয়ত লাভের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অসংখ্য পরীক্ষা দিয়েছেন।

এভাবে দেখা যায়, সর্বপ্রথম থেকে সর্বশেষ— সব নবীর জীবনেই বিপদ এসেছে। কিন্তু প্রত্যেক নবীই বিপদে ধৈর্য না হারিয়ে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং তাঁর সাহায্য কামনা করেই বিপদমুক্ত হয়েছেন।

অতএব, জীবন চলার পথে ছোট বড় পরীক্ষা আসবেই। কিন্তু বিপদাপদে কখনো এ কথা বলা উচিৎ নয়— আল্লাহ আমার সঙ্গেই কেন এমন করছেন?

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এসব বিপদাপদ ও বালা-মুসিবতে ইসলামের বিধান মেনে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দিন।

মন্তব্য করুনঃ

মন্তব্য সমূহ ( ১ টি মন্তব্য পাওয়া গেছে )

  • মোঃশরিফুল আলম
    Dec 04, 2021 — 11:57 AM

    প্রিয় ভাইয়ের লেখা নিয়ে মন্তব্য করার জ্ঞান অর্জন করতে পারিনি।আশা করি প্রিয় ভাইয়ের লেখা পড়ে সবাই উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ।ভাইয়ের জন্য দোয়া ও ভালোবাসা সবসময়❤️

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ