বুধবার, ০৮ মে ২০২৪

রমজানের সাহরি ও ইফতারের গুরুত্ব

 

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের  অন্যতম স্তম্ভ হলো  রমজানের রোজা।রোজার পাঁচটি সুন্নতের প্রথমটি হলো সাহরি বা ভোর রাতের খাবার । মধ্যরাতের পর থেকে সুবহে সাদিক তথা ফজর ওয়াক্তের আগের সময়টাকে সাহরি খাওয়ার সময় বল হয়। রমজানে সাহরি একটি বরকতময় ইবাদত।

মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন অর্ধরাত্রি থেকে সাহরির সময় শুরু হয়। (মিরকাত শরহে মিশকাত)। ইমাম যামাখ্শারী (রহঃ) ও ফকিহ আবুল লাইছ সমরকন্দী (রহঃ) বলেন, সাহরির সময় হলো রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে। সাহরি শেষ সময়ে খাওয়া সুন্নত।  তবে সন্দেহের সময় পর্যন্ত দেরী করা যাবে না।মোট কথা হলো সময় শেষ হওয়ার আগেই সাহরি খাওয়া শেষ করতে হবে। শেষ সময়ে সাহরি খেলে যেমন রোজা রাখা সহজ হয়, তেমনি নবীজির সুন্নত আদায় হয়।

হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) বলেন, রাসুল করিম (সঃ) ইরশাদ করেন তোমরা সাহরি খাও;যদি তা এক ঢোক পানিও হয়। অন্যত্র বলেন,  ' তোমরা সাহরি খাও যদি এক লুকমা খাদ্যও হয়। উপরিউক্ত হাদিস সমূহে রাসুল (সঃ) সাহরির গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। এক ঢোক পানি , এক লুকমা খাদ্য, এক কাপ দুধ, সামান্য ফল ফলাদি বা একটি খেজুরের মতো যৎসামান্য হলেও সাহরি খাওয়া সুন্নত।  রমজানে রোজার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে পানাহার করাকে সাহরি বলা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ইহা সুন্নত হলেও প্রকৃত তাক্বওয়া অর্জন এবং আত্মার পরিসুদ্ধির জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) ইরশাদ করেন, তোমরা সাহরি খাও কেন না সাহরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারি শরীফ,সওম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ১,২০৩, খন্ড: ৩, পৃষ্টাঃ ২৫০, হাদিস১,৮০১)।

হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে রাসুল (সঃ) বলেন, আমাদের (মুসলমানদের) রোজা আর আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান) দের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া আর না খাওয়া। (মুসলিম, আলফিয়্যাতুল হাদিস,পৃষ্টা:১৩১)।

সাহরি খেলে একদিকে যেমন শারীরিক শক্তি অর্জিত হয়, অপর দিকে সুন্নতও আদায় হয় এবং তাক্বওয়া অর্জনে সহায়ক হয়। স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ইবাদত করতে মজা লাগে,  শেষ রাতে তাহাজ্জতের নামাজ পড়া যায়, যিকির-আজকার ও দোয়া মুনাজাতের সুযোগ লাভ হয়।এই ধরণের আল্লাহ প্রেমিকদের জন্য আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, তারা (ইমানদারগণ) রাত্রির শেষ অংশে আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করে থাকে।(সুরাঃ আয-যারিয়াত,আয়াত:১৮, পারা :২৬)।

কোনো কারণে সাহরি খাওয়া সম্ভব না হলেও রোজা  রাখতে হবে। কোনো প্রকার অজুহাত বা এহেন ওজর রোজা ছাড়ার জন্য গ্রহনযোগ্য কারণ নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে সাহরি বর্জন করা ঠিক নয় এবং সুন্নতের বর্খেলাপ। তা ছাড়া, নবীজি (সঃ) বলেছেন, সাহরি ছাড়া রোজা রাখা ইহুদি-নাসারাদের ধর্ম |

তাই সাহরি খেয়ে ইসলামি রোজার নিজস্ব নীতি রক্ষা করে রোজা পালন করা ইমানদার মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব।

মাসয়ালা:
যদি কেউ এমন অবস্থার স্বিকার হন যে, ফরজ গোসল করে সাহরি খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই; তখন অজু করে বা হাত-মুখ ধুয়ে আগে সাহরি খেয়ে নিবেন। পরে গোসল করে পবিত্র হয়ে ফযরের নামাজ আদায় করে নিবেন। কারন সাহরি খাওয়ার জন্য পবিত্রতা অর্জন করা ফরজ নয় বরং সুন্নত। আর নামাজ আদায় করার জন্য পবিত্রতা অর্জন করা ফরজ।গোসল ফরজ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পবিত্র হয়ে নেওয়া। আর রমজানের রোজা অবস্থায় বেশিক্ষন অপবিত্র থাকা মোটেও বা নীয় নয়। এটা মাকরুহ। এতে করে রহমতের ফেরেস্তাদের কষ্ট হয় ; তাই দ্রæত পবিত্রতা অর্জন করা জরুরি ( আল কুদুরি: ফতুয়ায়ে আলমগীরী)

ইফতারের  গুরুত্ব:-
রমজানের পাঁচটি সুন্নতের দ্বিতীয়টি হলো ইফতার। ইফতার অর্থ হলো উপবাস ভঞ্জন বা ভঙ্গ করা। রোজা রেখে সূর্যাস্তের পর প্রথমে যে পানাহার করে তাকে ইফতার বলে। ইফতারের সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফঠতার করা উত্তম। ইফতারের সময় হওয়ার পূর্বেই ইফতার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথা সময়ে ইফতার করপা সুন্নত।এছাড়া ইফতার সামনে নিয়ে ইস্তেসফার করা আল্লাহর দরবারে দোয়া করা। আর এই সময়ের বান্দার দোয়া আল্লাহর দরবারে গুরুত্বের সাথে কবুল করা  হয়। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রোজাদারের দোয়া আল্লাহর কাছে এতই গুরুত্বর্পুণ যে তিনি রমজানের সময় আরশ বহনকারী ফেরেস্তাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন রমজানের তোমাদের পূর্বের দায়িত্ব মওকুফ করা হলো, এবং নতুন দায়িত্বের আদেশ করা হলো, আর তাহলো আমার রোজাদার বান্দাগণ যখন কোন দোয়া, মোনাজাত করবে, তখন তোমরা আমিন আমিন বলতে থাকবে। এই হাদিস দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আরশের চেয়েও রোজাদারের দোয়ার সঙ্গে আমিন! আমিন! বলা অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা একমাত্র রোজাদারদের  সম্মানে করা হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (স:) ইরশাদ করেন, হাদীসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: আমার বান্দাদের মাঝে তারা আমার কাছে বেশি প্রিয়, যারা দ্রæত ইফতার করে। (তিরমিযি শরীফ, আল    ফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬০,পৃ: ১৩১)।

হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূল (স:) ইরশাদ করেন, যখন রাত্র সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে এবং দিন এদিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন রোজাদার ইফতার করবে। ( বুখারী শরীফ, সওম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ১২২৫, খন্ড: ৩, পৃ:২৬৭, হাদিস: ১৮৩০)।

হযরত  সাহল ইবনে সা’আদ (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূল (দ:) করেন: যতদিন যাবৎ লোকেরা ওয়াক্ত হওয়া মাত্র ইফতার করবে, ততদিন কল্যানের ওপর থাকবে। ( বুখারী শরিফ, সওম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ১২২৭, খন্ড: ৩, পৃ:২৬৮, হাদিস: ১৮৩৩)। অন্যএক হাদিসে আছে যতদিন ইসলাম টিকে থাকবে ততদিন রোজাদার দ্রæত ইফতার করবে। কারন ইহুদি - খ্রিষ্টানরা বিলম্বে ইফতার করত। এত সব হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, ইফতার শুধু ক্ষুদা  নিবারনের জন্যেই নয়, বরং এটা একটা গুরুত্বর্পূণ ইবাদত। তাই ইফতারের সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকা আমাদের জন্য জরুরী।
 
ইফতারের সুন্নত সমূহ:-
খুরমা, খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কোন খাদ্য দ্বারা  ইফতার করা সবচেয়ে উত্তম। অর্থের কারনে যদি এগুলোর দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহলে যেকোন ফল (নিজের সাধ্যের ভিতরে ) দ্বরা ইফতার করা সুন্নত। আর যদি এটা সম্ভব না হয়, তাহলে যেকোন হালাল খাবার দ্বারা এমনকি শুধু পানির দ্বারাও ইফতার করা যায়।

হযরত সালমান ইবনে আমির (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (স:) ইরশাদ করেন: তোমাদের কেউ রোজা রাখলে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। আর খেজুর না হলে পানি দিয়ে, নিশ্চয় পানি পবিত্র। ( আহমাদ,তিরমিযি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমি শরীফ; আল ফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬২ পৃ: ১৩১-১৩২)।

হাদিসে পানি মিশ্রিত দুধ (ঘোল ও মাধা) দ্বারা ইফতার করা হুকুমত আছে। ইফতারের সময় দোয়া পাঠ করা সুন্নত । আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু বিরহ্ মাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন। অর্থ: হে আল্লাহ আপনার জন্য আমি রোজা রেখেছি, আপনার রিযিক দ্বারা আমি ইফতার করছি। আপনি পরম দয়াবান ও দয়ালূ।
 
রোজাদারকে ইফতার করানোর ফযিলত:-
হযরত সালমান ফারসী বর্ণনা করেন, রাসূল (স:) ইরশাদ করেন:’ যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে, ওই রোজাদারের রোজার সওয়াবের সমপরিমান সওয়াব সে লাব করবে। এতে করে ঐ রোজাদারের সওয়াবের কোনো কম করা হবে না। একথা শুনে সাহাবায়ে কেরামের অনেকে বলে উঠলেন ইয়া রাসূল আল্লাহ আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। রাসূল (স:) বলেন পানি মিশ্রিত এককাপ দুধ বা একটি খেজুর  অথবা এক ঢোক পানি দ্বারাও যদি কেউ কোন রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই পরিমান সওয়াব দান করবেন্ আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে ইফতার করাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউসে কাউসার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না।
 
তাই আমাদের উচিত আমাদের পাড়া মহল্লায় খোঁজ খবর নিয়ে যাদের ইফতার কিনার সামর্থ্য নাই তাদেরকে ইফতার করানো, এতে মানবতার যেমন সেবা হবে তেমনি আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তি লাভ হবে।
 
হাফেজ মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক ভূঁঞা
এম.এ. কামিল (হাদিস)
সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া , ঢাকা ।

মন্তব্য করুনঃ

মন্তব্য সমূহ ( ১ টি মন্তব্য পাওয়া গেছে )

  • মোঃমোস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া
    Apr 09, 2022 — 1:49 PM

    মাশাআল্লাহ,
    চমৎকার লেখা হয়েছে!

    লেখক আমার বড় ভাই

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ